শিশু শ্রম নীরসন নীতিমালা
(Child Labor Remediation
Policy)
উদ্দেশ্যঃ নিয়োগ নীতিমালা ও বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধনী-১৩,১৮) এবং শ্রম বিধি-১৫ সংশোধনী-২২ অনুযায়ী কারখানায় শিশু শ্রম নীরসন নীতিমালা বাস্তাবায়ন করা। | |
নীতিমালা কার্যকরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি/ বিভাগঃ কমপ্লায়েন্স এবং মানব সম্পদ বিভাগ । | |
নীতিমালা সর্বশেষ সংশোধনের তারিখঃ | পরবর্তী সংশোধনের তারিখঃ |
বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কৌশল আজ তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের জন্যে একটি মডেল। আজকের যে শিশু-কিশোর তাঁরাই হবেন আগামী দিনে এই উন্নয়ন কৌশলের মূল চালিকাশক্তি। তাঁদেরকে উপযোগী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন আশাপ্রদ নয়। স্বাধীনতার পর পরই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে প্রবর্তন করা হয়েছে শিশু আইন ১৯৭৪। পরবর্তীতে প্রণয়ন করা হয়েছে জাতীয় শিশু নীতি ১৯৯৪ এবং গ্রহণ করা হয়েছে শিশুদের জন্য জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা ২০০৫-২০১০ সহ বহুবিধ উন্নয়ন প্রকল্প। আšতর্জাতিক অঙ্গনেও জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ এবং আšতর্জাতিক শ্রম সংস্থার শিশু বিষয়ক অধিকাংশ সনদ অনুসমর্থনসহ শিশু অধিকার সংক্রাšত বহু আšতর্জাতিক, আঞ্চলিক ও দ্বি-পাক্ষিক ঘোষণায় বাংলাদেশ অংশীদার। গৃহীত এ সকল পদক্ষেপ এবং সরকার, মালিক,শ্রমিক পক্ষের ঐক্যমত ও আšতরিকতায় তৈরী পোষাক শিল্প হতে শিশুশ্রম প্রত্যাহার আšতর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। তা সত্তে¡ও বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। কৃষি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক/অনানুষ্ঠানিক খাতে শিশুশ্রম বিদ্যমান। একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে শিশুশ্রম সংক্রাšত এ পরিস্থিতি অনভিপ্রেত।
শ্রমজীবী শিশুর সংজ্ঞা ও বয়স
শিশু-কিশোরদের সংজ্ঞা নির্ধারণে বয়সের বিষয়টিই মুখ্য বিধায় সরকারি দলিলে শিশু-কিশোরদের একটি অভিন্ন বয়স নির্ধারণ করা সম্ভব হলে ভাল হত, বিভিন্ন মহল থেকে এমনটি দাবীও করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের শিশুদের সাথে উন্নত দেশের শিশুদের শারীরিক ও মানসিক গঠন
এবং শিশুদের বহুমাত্রিক অধিকারকে নিশ্চিত করতে যেয়েই দলিল ভেদে বাংলাদেশের শিশুদের বয়সের এই বিভিন্নতা। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (২০০৬ সনের ৪২ নং আইন)-এ শিশু ও কিশোর এর সংজ্ঞাও বয়সভিত্তিক। এ আইনের ২(৮) নং ধারায়
চৌদ্দ বৎসর বয়স পূর্ণ করিয়াছে কিন্তু আঠার বৎসর বয়স পূর্ণ করেন নাই এমন কোন ব্যক্তি কিশোর এবং ২(৬৩) নং ধারায় চৌদ্দ বৎসর বয়স পূর্ণ করেন নাই’ এমন কোন ব্যক্তিকে “শিশুহিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। তবে শিশুশ্রম বা শিশুশ্রমিক এর কোন সংজ্ঞা
সরকারি-বেসরকারি কোন দলিলে পরিলক্ষিত হয় না। এমতাবস্থায়, শিশুশ্রম সংক্রাšত যাবতীয় আলোচনায়
শিশু ওকিশোর’ এর সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (২০০৬ সনের ৪২ নং আইন)
শিশু ও কিশোর এর বয়সভিত্তিক সংজ্ঞাটি অনুসরণীয়। এ সংজ্ঞা অনুযায়ী কোন শিশু দ্বারা সম্পাদিত শ্রম শিশুশ্রম হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে শিশুশ্রমিক বলে কোন ব্যক্তি-শ্রমিক এর অস্তিত্ব থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। শ্রমে নিয়োজিত শিশুর বিশেষণ হিসেবে শিশু শ্রমিক এর স্থলে শ্রমে নিয়োজিত শিশু বা শ্রমজীবী শিশু ইত্যাদি বাক্য/বাক্যসমূহ ব্যবহার করতে হবে।
শ্রমজীবী শিশুর কর্মপরিবেশ
শিশুদের শ্রমে নিয়োগে ব্যাপক বিধিনিষেধ থাকা সত্তে¡ও পারিপার্শি¦ক অবস্থা ও পরিস্থিতির বিপাকে কোন কোন শিশু এক সময় শ্রমে নিয়োজিত হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে শিশুর কর্মপরিবেশ যেন অনুকুলে থাকে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। শ্রমে নিয়োজিত একজন শিশু যদি:
অ) দৈনিক সর্বোচ্চ পাঁচ কর্মঘন্টার অতিরিক্ত সময় কাজ করে;
আ) এমন কাজ করে যা তার শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক অবস্থার উপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করে;
ই) নিরাপত্তাহীন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকে;
ঈ) বিনামজুরি, অনিয়মিত মজুরি, স্বল্প মজুরিতে কাজ করে;
উ) সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে;
ঊ) শিক্ষা জীবনকে ব্যাহত করে;
ঋ) বাধ্য হয়ে কাজ করে;
এ) ব্যক্তি মর্যাদাকে হেয় করে দাসের মত কাজ করতে বাধ্য হয়;
ঐ) শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচার এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয় এবং
ও) বিশ্রাম বা বিনোদনের কোন সুযোগ না পায়;
তাহলে উক্ত পরিবেশ শিশুর জীবন, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং অমর্যাদাকর। এ পরিবেশ থেকে শিশুকে উদ্ধারে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শ্রমে নিয়োজিত একজন শিশুর কর্মপরিবেশ উন্নয়নের জন্য নিয়োগকর্তা/মালিক কর্তৃক শিশু এবং শিশুর অভিভাবকের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে নিম্নবর্ণিত শর্তাবলী প্রতিপালন করবে:
(ক) শিশুর সামর্থ্য অনুযায়ী ঝুঁকি বিহীন কাজ
§
শিশুকে আইনের দ্বারা কর্মে নিয়োগের নির্ধারিত বয়স অনুযায়ী কাজে নিযুক্ত করা এবং ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুকে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে নিয়োগ না করা;
§
গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুরা সাধারণত সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে নিযুক্ত হয় বিধায় তার লেখা-পড়া, থাকা-খাওয়া, আনন্দ-বিনোদন নিশ্চিত করার পাশাপাশি তার দৈনিক কর্মঘন্টা পাঁচ ঘন্টার মধ্যে সীমিত রাখা এবং তাকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো থেকে বিরত রাখা;
§ শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন না করা।
(খ) কাজের শর্ত
বিধিমোতাবেক শিশুদেরকে কাজে নিয়োগের পূর্বে নিয়োগকর্তা/মালিকগণ শিশু এবং শিশুর অভিভাবকের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে কাজের সুস্পষ্ট শর্ত তৈরি করবেন। এ তালিকায় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে যা সেক্টর অনুযায়ী প্রযোজ্য হবে:
§ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ থেকে বিরত থাকা;
§ দৈনিক কর্মতালিকা থাকা;
§ দৈনিক কর্মঘন্টার উলেখ;
§ সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন ছুটির ব্যবস্থা;
§ লেখাপড়া অথবা দক্ষতা বৃদ্ধি বিষয়ক প্রশিক্ষণের সুযোগ;
§ নির্র্দিষ্ট হারে নিয়মিত বেতন প্রদান;
§ চাকুরিচ্যূতির কমপক্ষে এক মাস পূর্বে অবহিত করা, ইত্যাদি।
(গ) কর্মস্থলের পরিবেশ
§ কর্মস্থলের পরিবেশ অবশ্যই শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অনুকুল হতে হবে;
§ কর্মস্থলের পরিবেশ কখনই এমন হবে না, যা শিশুকে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হতে বাধ্য করে অথবা উৎসাহিত করে;
§ অমর্যাদাকর বা মানহানিকর কোন কাজে শিশুকে নিয়োগ বা লিপ্ত করা যাবে না।
(ঘ) শিক্ষা ও বিনোদন
§ যেহেতু শিক্ষা ও বিনোদন শিশুর মৌলিক অধিকার, সে কারণে কর্মঘন্টার অর্থাৎ দৈনিক পাঁচ ঘন্টার পর একটি নির্দিষ্ট সময় ( কমপক্ষে ত্রিশ মিনিট হতে এক ঘন্টা) বিরতি দিয়ে যথাযথ শিক্ষা /বিনোদনের সুযোগ ও সুব্যবস্থা রাখা;
§ শিশুরা যে কাজেই নিযুক্ত থাকুক না কেন, কর্মঘন্টা অতিক্রান্ত হওয়ার পর উক্ত শিশুর যথাযথ শিক্ষা ও বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি মালিক/নিয়োগকর্তাগণ নিশ্চিত করবেন।
(ঙ) চিকিৎসা
§ কর্মকালীন সময়ে শিশু কোন দুর্ঘটনায় পতিত হলে অথবা অসুস্থ হলে মালিক/নিয়োগকর্তাগণ যথোপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন;
§ অসুস্থতার সময় শিশুদের পরিবারের সাথে নিয়মিত সাক্ষাতের বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে।
(চ) পরিবারের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ
§ গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের নিয়মিত পিতা-মাতা বা আত্মীয়-স্বজনের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ প্রদান করতে হবে;
§ অন্যান্য কর্মে নিয়োজিত শিশুদের ক্ষেত্রেও প্রতি মাসে কমপক্ষে একবার পিতা-মাতা বা আত্মীয়-স্বজনের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ প্রদান করতে হবে।
(ছ) শিশুর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার ব্যবস্থা
§ কোন শিশু ক্রমাগত ছয় মাস কাজ করলে সাধ্যানুযায়ী শিশুর ভবিষ্যত আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে, যেমন: বীমা, সঞ্চয়, ইত্যাদি;
§ শিশুরা সহজেই কারিগরি বিষয় রপ্ত করতে পারে। শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের প্রচলিত আইনের আলোকে উন্নততর প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে যেন আগামী দিনে তারা বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে নিজেদেরকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে;
§ কর্মমেয়াদ শেষে এককালীন আর্থিক সুবিধা প্রদান করা।
সুস্থ ও স্বাভাবিক শৈশবের নিশ্চয়তা সকল শিশুর জন্মগত অধিকার। শিশুর এ শাশ্বত অধিকার থেকে আমাদের দেশের বহু শিশুই আজও বঞ্চিত। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা জীবিকা অর্জনের তাগিদে বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বা নিকৃষ্ট ধরনের শ্রমে নিয়োজিত হয় যা শিশুদেরকে ঠেলে দেয় এক অপ্রত্যাশিত ভবিষ্যতের দিকে। এ দলিলের আলোকে যদি শিশু ও শিশুশ্রম সংক্রাšত বিরাজমান আইন ও আইনের বিধি-বিধানগুলোর পুনর্বিন্যাস এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বা¯তবায়ন করা যায় তবে আমাদের শিশুরা আগামীতে অবশ্যই আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। ------------------------------------------------------------ লিঃ
কর্তৃপক্ষ শিশুদের নিরাপদ ও নিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য বদ্ধ পরিকর।
প্রস্ততকারী সমন্বয়কারী অনুমোদনকারী
0 Comments